বাংলাদেশের চাঁদপুর, যেখানে পদ্মা, মেঘনা এবং ডাকাতিয়া নদীর মোহনা মিলিত হয়েছে, সেই জায়গাটি একদিকে যেমন অপূর্ব সৌন্দর্যের আধার, তেমনই বহু গল্প-কাহিনির জন্মদাতা। এই মোহনা শুধু নদীর মিলনস্থল নয়, বরং এটি বহুকাল ধরে স্থানীয়দের কাছে এক রহস্যময় এবং ভয়াবহ জায়গা হিসেবে পরিচিত। চাঁদপুরের তিন নদীর মোহনা রাতের বেলা ভয়ঙ্কর জায়গা হিসেবে পরিচিত।
গ্রামের মাঝি রফিকুল হোসেন, যার পুরো জীবন এই মোহনায় নৌকা চালিয়ে কাটিয়েছে। রফিক ছিলেন সৎ ও সাহসী মাঝি। তবে তার দাদার সময় থেকেই এক গল্প চালু ছিল—তিন নদীর মোহনার গভীর অংশে এমন এক জায়গা আছে, যেখানে কোনো জাহাজ বা নৌকা গেলে আর ফিরে আসে না। রফিক এসব গল্প বিশ্বাস করতেন না। তার যুক্তি ছিল, নদীর স্রোতের জোরে এবং গভীরতার কারণে এমনটা হতে পারে। কিন্তু একদিন তার জীবনে ঘটে এমন কিছু, যা তার বিশ্বাস বদলে দেয়।
এক রাতে রফিক একটি যাত্রী বোঝাই নৌকা নিয়ে মেঘনার দিকে যাচ্ছিল। আকাশে মেঘ জমেছে, বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে। মাঝ রাতের দিকে মোহনার মাঝখানে পৌঁছানোর পরই তিনি শুনতে পান অদ্ভুত একটি কান্নার আওয়াজ। যাত্রীরাও সেই শব্দ শুনতে পায়। শব্দটি ঠিক যেন কোনো নারীর শোকাতুর কণ্ঠ। একজন যাত্রী বলল, “মাঝি ভাই, এই আওয়াজ আগে শুনেছি। শুনেছি এখানে অভিশপ্ত আত্মারা বাস করে। চলেন ফিরে যাই!” কিন্তু রফিক কথায় কান না দিয়ে সামনে এগোল। মুহূর্তেই নদীর পানি যেন অদ্ভুতভাবে ঘূর্ণি আকারে ঘুরতে শুরু করে। তাদের নৌকা নিয়ন্ত্রণ হারায়।
অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎই তারা দেখতে পায়, মোহনার মাঝখানে এক সাদা পোশাক পরা নারী ভেসে রয়েছে। তার চুল ভেজা, আর চোখ দুটি লাল আগুনের মতো জ্বলছে। তিনি নৌকার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললেন, “আমার সন্তানকে ফেরত দাও!” রফিক আতঙ্কিত হয়ে যাত্রীদের শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু সেই নারীর দিকে তাকাতেই তার শরীর হিম হয়ে যায়। মনে হচ্ছিল, কেউ যেন তার মন পড়তে পারছে।
তীব্র ঘূর্ণির স্রোত নৌকাকে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। রফিক প্রাণপণে চেষ্টা করলেও কিছু করতে পারছিল না। তার চোখে ভাসছিল সেই নারীর বিকৃত মুখ। যাত্রীরা আতঙ্কে চিৎকার করতে থাকে, কিন্তু কিছুই করার উপায় ছিল না। হঠাৎই নৌকা উল্টে যায়। রফিক নদীতে পড়ে যান। পানির নিচে ডুবতে ডুবতে তিনি দেখতে পান, সেই নারী তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
রাতের শেষে রফিককে একটি মাছ ধরা ট্রলার উদ্ধার করে। তিনি একমাত্র বেঁচে ফেরেন। তার চোখে ছিল প্রচণ্ড আতঙ্ক, আর মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। পরে তিনি জানান, “মোহনার গভীরতা শুধু স্রোতের জন্য ভয়ানক নয়। সেখানে এমন কিছু আছে, যা আমরা চোখে দেখতে পাই না।”
আজও চাঁদপুরের তিন নদীর মোহনা রাতের বেলা ভয়ঙ্কর জায়গা হিসেবে পরিচিত। অনেক মাঝি বলে, সেখানে এক অভিশপ্ত আত্মার শোক এখনও শোনা যায়। যারা সেই রাতের রহস্য বোঝার চেষ্টা করে, তারা আর কখনো ফিরে আসে না।